হযরত মরিয়ম (রাঃ) এর জীবনী: ইসলামের পবিত্র নারী চরিত্র
ইসলামে নারীদের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এবং সম্মানিত একজন হলেন হযরত মরিয়ম (রাঃ)। তিনি শুধুমাত্র মুসলিমদের কাছে নন, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের কাছেও পবিত্র একজন নারী চরিত্র হিসেবে গণ্য হন। কুরআনে তাঁর নাম ৩৪ বার উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাঁর নামে একটি সম্পূর্ণ সূরাও রয়েছে – সূরা মরিয়ম। তিনি নবী হযরত ঈসা (আঃ)-এর জননী, এবং তাঁর পবিত্র জীবনচরিত আজও বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে অনুপ্রেরণার উৎস।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
হযরত মরিয়ম (রাঃ) ছিলেন ইমরানের কন্যা। তাঁর পিতা ছিলেন এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি এবং মা ছিলেন একজন সাধ্বী নারী। হযরত মরিয়মের মা যখন তাঁর গর্ভে সন্তান ধারণ করেন, তখন তিনি আল্লাহর রাহে সন্তানকে উৎসর্গ করার মানত করেন। তিনি ভেবেছিলেন, তিনি পুত্রসন্তান জন্ম দেবেন যিনি আল্লাহর ইবাদতে মসজিদে নিয়োজিত থাকবেন। কিন্তু যখন কন্যাসন্তান জন্ম নিল, তখন তিনি বললেন:
“হে আমার প্রতিপালক! আমি তো কন্যাসন্তান প্রসব করেছি…” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৬)
কিন্তু আল্লাহ এই কন্যাসন্তানকেই বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানে ভূষিত করলেন। তাঁর নাম রাখা হয় “মরিয়ম” যার অর্থ "সেবা ও ইবাদতের জন্য নিবেদিত নারী"।
কৈশোরকাল ও ইবাদতের জীবন
হযরত মরিয়ম (রাঃ)-এর লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন নবী হযরত যাকারিয়া (আঃ), যিনি তাঁর মামা ছিলেন। তিনি হযরত মরিয়মকে মসজিদে নিয়ে গিয়ে আলাদা একটি স্থান তৈরি করে দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন।
আল-কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, হযরত মরিয়মের কাছে একবার যখন হযরত যাকারিয়া (আঃ) আসেন, তিনি মরিয়মের পাশে ফলমূল দেখতে পান যা ঐ ঋতুতে পাওয়া সম্ভব ছিল না। এ নিয়ে তিনি আশ্চর্য হয়ে জানতে চান:
“হে মরিয়ম! এগুলো কোথা থেকে এলে?” তিনি বললেন, “এগুলো আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এসেছে।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৭)
এ থেকেই বোঝা যায়, হযরত মরিয়ম (রাঃ) ছিলেন এক বিশেষ রূহানিয়তসম্পন্ন নারী, যাঁকে আল্লাহ নিজ হাতে লালন করতেন।
অলৌকিক গর্ভধারণ ও ঈসা (আঃ)-এর জন্ম
হযরত মরিয়ম (রাঃ)-এর জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা ছিল তাঁর অলৌকিক গর্ভধারণ। আল্লাহর হুকুমে, কোন পুরুষের স্পর্শ ছাড়াই তিনি গর্ভবতী হন। একদিন হযরত জিবরাইল (আঃ) তাঁর কাছে এক মানব রূপে এসে বললেন:
“আমি আপনার প্রতিপালকের একজন দূত, আপনাকে একটি পবিত্র পুত্র সন্তান দান করতে এসেছি।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ১৯)
এই সংবাদে হযরত মরিয়ম ভীত ও বিস্মিত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন:
“আমার কিভাবে সন্তান হবে, যখন আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শই করেনি?” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ২০)
আল্লাহ তাঁকে আশ্বস্ত করেন এবং বলেন, তাঁর জন্য এটি সহজ বিষয়। অবশেষে, হযরত মরিয়ম একটি পবিত্র সন্তান জন্ম দেন—যিনি হলেন হযরত ঈসা (আঃ)।
সন্তানের জন্ম এবং সমাজের প্রতিক্রিয়া
যখন হযরত মরিয়ম নবজাতক ঈসা (আঃ)-কে নিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের সামনে এলেন, তখন লোকেরা তাঁকে কটাক্ষ করতে শুরু করে। তারা তাঁকে চরিত্রহীন বলে অপবাদ দিতে থাকে। তখন আল্লাহর আদেশে, হযরত মরিয়ম কথা বলা বন্ধ রাখেন এবং নবজাতক ঈসা (আঃ)-এর দিকে ইশারা করেন।
অবাক করা বিষয়, নবজাতক ঈসা (আঃ) তখনই কথা বলেন এবং বলেন:
“আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দান করবেন এবং নবী বানাবেন।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৩০)
এই অলৌকিক ঘটনাটি ছিল আল্লাহর কুদরতের এক জ্বলন্ত প্রমাণ, যা হযরত মরিয়মের সম্মান রক্ষা করে।
মরিয়ম (রাঃ)-এর মর্যাদা কুরআনে
কুরআনে হযরত মরিয়ম (রাঃ)-কে আল্লাহ বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন:
“আর মরিয়ম, ইমরানের কন্যা, যিনি তাঁর সতীত্ব রক্ষা করেছিলেন। তারপর আমি তার মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং তাঁকে এবং তাঁর পুত্রকে জগতের জন্য নিদর্শন করেছিলাম।” (সূরা আল-আন্বিয়া, আয়াত ৯১)
এছাড়াও, হাদীসে হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:
“নারীদের মধ্যে মরিয়ম (ইমরানের কন্যা) শ্রেষ্ঠ।” – (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত মরিয়ম (রাঃ)-এর শিক্ষা ও উত্তরাধিকার
হযরত মরিয়ম (রাঃ)-এর জীবনী থেকে আমাদের শেখার অনেক কিছু রয়েছে। তিনি শিক্ষা দেন:
-
আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও ইমান
-
ধৈর্য ও সহনশীলতা
-
সমাজের অপবাদকে উপেক্ষা করে সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থাকা
-
আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল
তিনি প্রমাণ করেছেন, একজন নারী কিভাবে শুধু নিজের ঈমান ও চরিত্রের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সম্মানিত হতে পারেন।
মরিয়ম সম্পর্কে কুরআন কি বলে?
কুরআনুল কারিমে হযরত মরিয়ম (রাঃ) সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আয়াত আছে, যেখানে তাঁর জীবন, চরিত্র, অলৌকিক ঘটনা ও মর্যাদা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। নিচে কুরআনে মরিয়ম (রাঃ)-কে নিয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো:
🌸 ১. মরিয়মের মর্যাদা ও বিশুদ্ধতা
আল্লাহ তাআলা কুরআনে হযরত মরিয়ম (রাঃ)-কে সবচেয়ে পবিত্র ও নির্বাচিত নারীদের একজন হিসেবে উল্লেখ করেছেন:
"আর স্মরণ কর, মরিয়মকে, যাকে আমি সমস্ত নারীদের ওপর শ্রেষ্ঠতা দিয়েছি।"
— (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৪২)
এ আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহ তাঁকে বিশুদ্ধ করেছেন এবং সমস্ত নারী জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।
🌸 ২. অলৌকিক গর্ভধারণ
হযরত মরিয়ম (রাঃ) পুরুষের সংস্পর্শ ছাড়াই গর্ভবতী হন। এটি আল্লাহর এক অলৌকিক কুদরত ছিল। কুরআনে বলা হয়েছে:
“তিনি বললেন, ‘আমি কিভাবে সন্তান জন্ম দেব, যখন আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি?’ তিনি বললেন, ‘এটাই আপনার প্রতিপালকের আদেশ। এটা তো আমার জন্য সহজ, যাতে আমি তাকে মানুষের জন্য নিদর্শন ও আমার পক্ষ থেকে এক অনুগ্রহ করতে পারি।’”
— (সূরা মরিয়ম, আয়াত ২০-২১)
🌸 ৩. ঈসা (আঃ)-এর জন্ম এবং নবজাতকের কথা বলা
হযরত মরিয়ম যখন ঈসা (আঃ)-কে জন্ম দেন এবং তাঁকে নিয়ে জাতির সামনে আসেন, তখন নবজাতক ঈসা (আঃ) কথা বলেন:
“সে বলল, আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং নবী বানিয়েছেন।”
— (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৩০)
এটি ছিল এক অবিশ্বাস্য অলৌকিক ঘটনা যা মরিয়মের সতীত্ব ও মর্যাদার পক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রমাণ হিসেবে কাজ করে।
🌸 ৪. মরিয়মের ইবাদত ও সংযম
হযরত মরিয়ম (রাঃ)-এর ইবাদত, সংযম ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের কথা কুরআনে এভাবে এসেছে:
“আর মরিয়ম, ইমরানের কন্যা, যিনি তাঁর সতীত্ব রক্ষা করেছিলেন। তারপর আমি তার মধ্যে আমার রূহ (ফুঁ) দিয়ে দিয়েছিলাম এবং তাঁকে ও তাঁর সন্তানকে জগতবাসীর জন্য নিদর্শন করেছিলাম।”
— (সূরা আল-আন্বিয়া, আয়াত ৯১)
🌸 ৫. সূরা মরিয়ম – এককভাবে মরিয়ম (রাঃ)-এর নামানুসারে সূরা
পুরো কুরআনে নারীদের মধ্যে শুধুমাত্র হযরত মরিয়ম (রাঃ)-এর নামেই একটি সূরা রয়েছে—সূরা মরিয়ম (সূরা ১৯)। এখানে তাঁর গর্ভধারণ, সন্তান জন্ম ও তাঁর ধৈর্যশীলতা নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
🌸 ৬. আল্লাহর পক্ষ থেকে মরিয়মকে রিজিক প্রদান
মরিয়ম (রাঃ)-এর ইবাদতের সময় তাঁর কাছে অলৌকিকভাবে খাবার পৌঁছে যেত:
“যখন যাকারিয়া তাঁর কাছে মিহরাবে আসতেন, তিনি তাঁর কাছে রিযিক দেখতে পেতেন। তিনি বলতেন, ‘হে মরিয়ম! এগুলো কোথা থেকে এল?’ তিনি বলতেন, ‘এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে।’”
— (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৭)
🕌 সারসংক্ষেপে কুরআনের দৃষ্টিতে মরিয়ম (রাঃ):
-
তিনি সমস্ত নারীর মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
-
আল্লাহ তাঁকে পবিত্র, সংযমী এবং ধৈর্যশীল হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
-
তাঁর জীবনে বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে আল্লাহর হুকুমে।
-
ঈসা (আঃ)-এর অলৌকিক জন্ম তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
-
কুরআনে মরিয়মের চরিত্র নারীদের জন্য একটি আদর্শরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে।
শেষ কথা
হযরত মরিয়ম (রাঃ) কেবল একজন মা বা নারী নন—তিনি এক অনন্য উদাহরণ, একজন অনুপ্রেরণাদায়ক চরিত্র। তাঁর পবিত্র জীবনচরিত মুসলিমদের জন্য যেমন আদর্শ, তেমনি নারীদের মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।
আজকের যুগে, যখন নারী-সমাজ নানা দিক থেকে চ্যালেঞ্জের মুখে, তখন হযরত মরিয়ম (রাঃ)-এর জীবন থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। তিনি ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ, ঈমানদার ও আল্লাহর প্রেমে নিবেদিত নারী—যাঁর জীবনী চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।